তায়েফে ইসলামের দাওয়াত
মক্কায় দীর্ঘদিন ধরে রাসুলুল্লাহ সা. ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন। ততদিনে প্রায় দশবছর কেটে গেছে। মক্কায় যারা ঈমান এনেছিলেন তাদের অনেকে হিজরত করে চলে গেছেন হাবশায়। এর মধ্যে ইন্তেকাল করেছেন রাসুলুল্লাহ সা. এর সহধর্মিণী খাদিজা রা. এবং প্রাণপ্রিয় চাচা আবু তালিব। এতকিছুর পরও রাসুলুল্লাহ সা. ইসলামের দাওয়াত দেয়া বন্ধ করেননি। তার চেষ্টায় কোনো ভাটা পড়েনি। মহান আল্লাহর দেয়া নবুওয়তের দায়িত্ব তিনি পালন করে চলেছেন যথাযথভাবে।
চাচা আবু তালিব যতদিন ছিলেন ততদিন মক্কায় রাসুলুল্লাহ সা. নির্ভয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। কুরাইশ তাকে বাধা দিয়েছে বারবার। তাঁর ওপর অত্যাচার করেছে। তবু তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি আবু তালিবের ভয়ে। এবার চাচার ইন্তেকালের পর রাসুলুল্লাহ সা. দেখলেন মক্কায় তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই। তিনি ভাবলেন, মক্কার কাছের জনপদ তায়েফের গোত্রপ্রধানরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে হয়ত ইসলাম শক্তিশালী হবে। মক্কার কাফিররা ইচ্ছেমত মুসলিমদের অত্যাচার করতে পারবে না।
তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য এবং তাদেরকে ইসলামের সহযোগী হিসেবে পাওয়ার আশায় রাসুলুল্লাহ সা. তায়েফ যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তায়েফে ইসলামের দাওয়াত
এতদিন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ মক্কায় দাওয়াত দিয়েছেন। মক্কার আশে পাশের কোনো অঞ্চলে গিয়ে দাওয়াত দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশ আসেনি। দশম হিজরির শাওয়াল মাসে মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে একদিন তিনি রওয়ানা হলেন তায়েফের পথে। সাথে ছিলেন তাঁর আযাদকৃত দাস যায়দ ইবনে হারিসা রা.।
তায়েফ মক্কার কাছেরই একটি শহর। মক্কা থেকে এর দূরত্ব প্রায় একশ কিলোমিটার। রাসুলুল্লাহ সা. পায়ে হেঁটে রওয়ানা হন তায়েফের পথে। প্রায় একশ কিলোমিটারের পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা সহজ কোনো কাজ নয়। কিন্তু উটে চড়ে মক্কার বাইরে গেলে সবাই জেনে যাবে রাসুলুল্লাহ সা. দূরে কোথাও যাচ্ছেন। তখন মুশরিকরা তাঁর পিছহু নিবে বা তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। মক্কার লোকেরা যেন না জানতে পারে এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হন।
তায়েফে ছিল সাকিফ গোত্রের বসবাস। সাকিফ গোত্রের তিনজন সর্দারের সাথে রাসুলুল্লাহ সা. এর সাক্ষাৎ হয়। তাদের নাম ছিল যথাক্রমে আবদে ইয়ালিল, মাসউদ এবং হাবিব বনু আমর ইবনে উমাইর। রাসুলুল্লাহ সা. তাদের সাথে গিয়ে দেখা করেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ইসলামের দাওয়াত দেয়ার কারণে মক্কার কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তার সাথে যে আচরণ করেছে তা তাদেরকে বলেন এবং তাদেরকে আহবান করলেন যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করে তার সহযোগী হয়। দশদিন সেখানে থেকে রাসুলুল্লাহ সা. তাদেরকে দাওয়াত দিতে থাকেন।
তায়েফের গোত্র প্রধানদের আচরণ
সাকিফ গোত্র ছিল খুবই শক্তিশালী এবং অহংকারী। তাদের একজন বলল, আল্লাহ যদি সত্যি তোমাকে পাঠিয়ে থাকেন তাহলে আমি কাবার গিলাফ খুলে ফেলব। লোকটি অস্বীকার বশতঃ একথা বলেছিল। আরেকজন বলল, আল্লাহ তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পাননি নবি হিসেবে পাঠানোর জন্য? তৃতীয়জন উত্তর দিল অন্যভাবে। সে বলল, তুমি যদি সত্য নবি হয়ে থাকো তাহলে তোমাকে কিছু বলাটা আমার জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে। আর যদি তুমি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে তোমার সাথে আমার কথা বলাই উচিত নয়।
রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রতি তায়েফবাসীর আচরণ
তায়েফের গোত্রপ্রধানদের কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা. শুধু বলেছিলেন, তোমরা যদি এমনই বলে থাকো তাহলে তো আর কিছু করার নেই। তবে তোমরা শুধু আমার এখানে আসার কথা গোপন রেখো। রাসুলুল্লাহ সা. চাননি মক্কার কাফিররা জানুক তার তায়েফ আসার ঘটনা। তাহলে তারা রাসুলুল্লাহ সা. কে আরও কষ্ট দিবে। তিনি তো এসেছেন নবুওতের দায়িত্ব পালন করতে এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে।
তায়েফের গোত্রপ্রধানরা ছিল দুষ্ট প্রকৃতির লোক। তারা বলল, আমরা কুরাইশকে জানিয়ে দিব যে তুমি আমাদের কাছে এসেছিলে। শুধু তাই নয়, আমরা তোমাকে তায়েফ থেকে নিরাপদে বের হতেও দিব না। এই বলে তারা ছোট শিশু, ক্রীতদাস ও পাগলদের লেলিয়ে দেয় রাসুলুল্লাহ সা. এর বিরুদ্ধে। তারা ঢিল ছুঁড়তে থাকে রাসুলুল্লাহ সা. কে লক্ষ্য করে। পাথরের আঘাতে তার গা বেয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। রক্তে পায়ের সাথে জুতা লেগে যায়। যায়েদ ইবনে হারিসা রা. সাধ্যমত রাসুলুল্লাহ সা. কে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তার চেহারায় আঘাত লাগে এবং তিনিও প্রচণ্ড আহত হন।
তায়েফবাসী ধাওয়া করতে করতে রাসুলুল্লাহ সা. কে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। তায়েফে ছিল মক্কার কাফির রবিয়ার দুই পুত্র উতবা ও শাইবার বাগান। তাদের বাগানের ভেতর গিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. আশ্রয় নেন। রক্তে তখন সারা শরীর ভিজে গেছে। পায়ের জুতা লেগে গেছে পায়ের সাথে। সাথে থাকা যায়েদ ইবনে হারিসা রা. ও অনেক আহত।
প্রিয় বন্ধুর এই অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ জিবরাইল আ. কে পাঠান আল্লাহর রাসুলের কাছে। তিনি এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! আপনি আদেশ করুন। পাহাড়ের ফেরেশতারা দুই পাহাড়ের মধ্যে তায়েফবাসীকে পিষে ফেলবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, হয়ত তারা না বুঝলেও তাদের পরবর্তীরা বুঝবে।
সত্যিই তাই হয়েছিল। ৮ম হিজরিতে হুনায়নের যুদ্ধের পর তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। তায়েফ থেকে মুসলমানরা অনেক গণিমত লাভ করেছিলেন।
আহত অবস্থায় বাগানে বসে রাসুলুল্লাহ সা. মহান আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন। এই দুআটি বেশ অর্থবহ একটি দুআ। তায়েফের সেদিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করার মত কেউ ছিল না সেদিন। শুধু ছিলেন যায়দ ইবনে হারিসা রা.। তবে অনেক পরে একদিন রাসুলুল্লাহ সা. তায়েফের ঘটনা স্মৃতিচারণ করেছিলেন হযরত আয়েশা রা. এর কাছে। আয়েশা রা. জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! উহুদের যুদ্ধের দিনের চেয়ে কঠিন কোনো দিন কি এসেছিল আপনার জীবনে? রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, আমি আবদে ইয়ালিলকে ইসলামের দিকে আহবান করেছিলাম। কিন্তু সে আমার আহবানে সাড়া দেয়নি। তখন আমি বিষণ্ণ হয়ে চলে গেলাম। কারনুস সায়ালিব ( তায়েফ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার) যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার বিষণ্ণতা দূর হয়নি। তখন দেখি জিবরাইল আলাইহিস সালাম আমাকে ডাকছেন। তিনি বললেন, আপনি যদি চান তাহলে আমি আখশাবাইন তথা কঠিন শিলার দুই পাহাড়কে চাপিয়ে দিব। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, না তা হতে পারে না। হয়ত আল্লাহ তাদের বংশে এমন কাউকে পাঠাবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। [বুখারি : ৩২৩১]
এরপর রাসুলুল্লাহ সা. দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দুআ করেন। সেই দুয়ায় রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আমার দুর্বলতার এবং আমার কৌশলের স্বল্পতা এবং মানুষের কাছে আমার তুচ্ছতার অভিযোগ করছি। আপনি কার কাছে আমাকে সোপর্দ করছেন? আপনি কি আমাকে শত্রুর কাছে অর্পন করছেন যে আমার সাথে মন্দ আচরণ করে অথবা যে আমাকে আয়ত্ত্বাধীন করে নিয়েছে? যদি আমার প্রতি আপনার কোনো ক্রোধ না থাকে তাহলে আমি পরোয়া করি না। তবে আপনার দেয়া সুস্থতা আমার জন্য বেশি প্রশান্তিদায়ক। আপনি আপনার মহান সত্ত্বার মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যার মাধ্যমে আঁধার আলকিত হয় এবং দুনিয়া অ আখেরাতের সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। আমার ওপর যেন আপনার ক্রোধ বা রাগ না নেমে আসে। আপনার জন্য সন্তুষ্টি যতক্ষণ না আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয় বা শক্তি নেই। [তাবারানি]
এই দুআটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। এত কষ্ট পাবার পরও রাসুলুল্লাহ সা. আল্লাহর কাছে তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে বদদোয়া করেননি। বরং আশা প্রকাশ করেছেন যে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়ত ঈমান আনবে। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ না করে নিজের অক্ষমতার কথা বলেছেন এবং আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করেছেন। এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসুল সা.।
বাগানে আশ্রয় নেয়ার পর বাগানের লোকজন দূর থেকে দেখছিল যে তাদের বাগানে এসে রাসুলুল্লাহ সা. আহত অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছেন। তারা এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সা. কে আর কিছু বলেনি। আসলে মহান আল্লাহ তাদের মনে দয়া ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই বাগানে আদ্দাস নামে একজন খ্রিস্টান দাস ছিল। বাগানের মালিকদের একজন এক থোকা আঙ্গুর আদ্দাসকে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে পাঠায়।
ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সা. আশ্রয় নিয়েছিলেন। আঙ্গুর হাতে নিয়ে তিনি বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করেন। আদ্দাস রাসুল সা. এর মুখে "বিসমিল্লাহ" শুনে অবাক হয়। সে বলে, আমার দেশের মানুষজন এভাবে বিসমিল্লাহ বলে খায়। রাসুলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন দেশের অধিবাসী। আদ্দাস জানায়, সে ইরাকের নিনাওয়ার অধিবাসী। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি কি ইউনুস আলাইহিস সালামের দেশের লোক? আদ্দাস ইউনুস আলাইহিস সালামের নাম শুনে অবাক হয়ে যায়। সে বলে, আপনি ইউনুস নবির কথা কীভাবে জানেন? তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তিনি আমার ভাই। তিনি ছিলেন একজন নবি, আমিও একজন নবি।
আসলে আদ্দাস ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারী। সে আগের নবিদের কথা জানত। কিন্তু মক্কার লোকদের তো এসব জানা ছিল না। তাই সে রাসুলুল্লাহ সা. এর মুখে বিসমিল্লাহ ও ইউনুস আলাইহিস সালামের কথা শুনে বুঝে ফেলে যে তিনি সত্য নবি। আদ্দাস রাসুলুল্লাহ সা. এর হাত ধরে চুমো দেয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে। দূর থেকে বাগানের মালিকরা এই দৃশ্য থেকে বলে, হায়! আমাদের গোলামকে সে নষ্ট করে দিল। আদ্দাস ফিরে আসার পর তাকে ঘটনা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, এই পৃথিবীতে এই মানুষটির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই।
আসলে মহান আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত দান করেন। রাসুলুল্লাহ সা. তায়েফে দশদিন থাকার পরও সেখানকার কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। অথচ সামান্য একজন বাগানের ক্রীতদাস শুধুমাত্র বিসমিল্লাহ শুনেই ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিল। কত সৌভাগ্য ছিল সেই আদ্দাসের।
লেখক: নাজমুস সাকিব
প্রকাশের তারিখ : ৭ জুলাই ২০২৪
শেয়ার করুন :
Currently Reading
