রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনে দুঃখের বছর
মক্কী জীবনে নানা ঘটনার পর একটি দুঃখের সময় আসে রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে আপন দুজন মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই বছর। তারা হলেন রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রাণপ্রিয় চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজা রা.।
আবু তালিবের ইন্তেকাল
রাসুলুল্লাহ সা. এর চাচা আবু তালিব এই বছর ইন্তেকাল করেন। তিনিই ছোটবেলা থেকে রাসুলুল্লাহ সা. কে বড় করেছেন। যুবক বয়সে ব্যবসা শিখিয়েছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। নবুওত লাভের পর কাফিরদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছেন। বিশেষ করে কাফিররা বার বার তাকে চাপ দিয়েছে মুহাম্মদ সা. কে তাদের হাতে তুলে দিতে। এমনকি কুরাইশের কাফিররা আবু তালিবসহ বনু হাশিমের সবার ওপর যখন অবরোধ আরোপ করে। তখনও আবু তালিব রাসুলুল্লাহ সা. এর পক্ষে ছিলেন এবং কঠিন সময়ে তাকে আগলে রেখেছিলেন।
বৃদ্ধ আবু তালিব যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনও রাসুলুল্লাহ সা. তার কাছে কালিমার দাওয়াত নিয়ে যান। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, চাচা, আপনি শুধু বলুন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য এই কালিমার মাধ্যমে আপনার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করব। সেসময় আবু জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়াসহ কাফির সর্দাররা আবু তালিবের সামনে উপস্থিত ছিল। তারা তখন বলল, আবু তালিব, তুমি তোমার বাবা আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে এই সময়ে? তারা আবু তালিবকে নানা কথায় ব্যস্ত রাখে।
মৃত্যুশয্যায় তখন কাফির নেতারা এসে তার ঘরে ভিড় করে। তারা বলে, আবু তালিব, তুমি জানো আমাদের কাছে তোমার অবস্থান কোথায়। এটাও জানো যে তোমার ভাতিজা এবং আমাদের মধ্যে কী সমস্যা রয়েছে। তুমি তোমার ভাতিজাকে ডাকো। তোমার সামনে আমরা তাকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিব এবং তার কাছ থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি নিব। সে যেন আমাদের থেকে বিরত থাকে। আমরাও তার থেকে বিরত থাকব। সে যেন আমাদেরকে এবং আমাদের ধর্মকে এড়িয়ে চলে। আমরাও তাকে এবং তার ধর্মকে এড়িয়ে চলব। আবু তালিব তখন মুহাম্মদ সা. কে ডেকে পাঠান। তাকে বলেন, তোমার কওমের নেতৃবৃন্দ এসেছে। তারা তোমাকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিবে এবং তোমার থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি নিবে। রাসুলুল্লাহ সা. তখন বলেন, তোমরা কি আমাকে এমন একটি কথা বলবে যার মাধ্যমে তোমরা আরবে রাজত্ব করবে এবং অনারবরা তোমাদের কাছে মাথানত করবে? তখন আবু জাহল বলে, এমন দশটি কথা আমরা বলতে প্রস্তুত আছি। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তোমরা শুধু বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আর আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত তোমরা করো তা ছড়ে দাও। একথা শুনে কাফিইররা সবাই মিলে হাততালি দেয়। তারা বলতে থাকে, মুহাম্মদ, তুমি আমাদের সকল দেবতাকে এক ইলাহ বানাতে চায়। এ তো বড়ই আজব কথা!
আবু তালিব তখন বলেন, মুহাম্মদ, আমার মনে হয় না তুমি তাদেরকে অন্যায় কিছু বলেছ। কাফিরদের এই কথার প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেন।
"তারা আশ্চর্য হয়েছে এ কারণে যে তাদের কাছে এসেছে একজন সতর্ককারী। তখন কাফিররা বলল, এ তো একজন মিথ্যাবাদী যাদুকর। সে কি আমাদের দেবতাদের এক ইলাহ বানিয়েছে। এ তো বড়ই আশ্চর্যের।" [সুরা সাদ : ৪-৫]
আবু তালিব কি ঈমান এনেছিলেন
আবু তালিব ঈমান আনেননি। তিনি নিজ ধর্মে থেকে মারা যান। রাসুলুল্লাহ সা. খুব চেয়েছিলেন যেন আবু তালিব ঈমান আনেন। মৃত্যুশয্যায় কালিমার দাওয়াত দেয়ার পর আবু তালিব বলেছিলেন, ভাতিজা, যদি কুরাইশ তোমাকে গালমন্দ না দিত, যদি আমার পর তোমার গোত্রীয় ভাইদের ভয় না থাকত, যদি কুরাইশ না ভাবত যে আমি মৃত্যুভয়ে এই কালিমা পড়েছি, তাহলে অবশ্যই আমি এই কালিমা উচ্চারণ করতাম।
আবু তালিব মৃত্যুর আগে ঈমান এনেছিলেন এমন কিছু বর্ণনাও পাওয়া যায়। আব্বাস রা. বলেছিলেন, ভাতিজা, তুমি তোমার চাচার কাছে যে কালিমা শুনতে চেয়েছিলে তিনি তা বলেছেন। অবশ্য তখন আব্বাস রা. নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাছাড়া সেই বর্ণনার সূত্রে একজন বর্ণনাকারীর পরিচয় কারো জানা নেই। তাই এই বর্ণনাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
আবু তালিব ঈমান এনেছেন এটা জানলে নিশ্চই আমাদের আনন্দ ষোলকলায় পূর্ণ হত। আল্লাহর রাসুল সা. কে যিনি এত ভালোবেসেছিলেন তিনি ঈমান এনে জান্নাতে যাবেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছার ওপর কারো কিছু বলার নেই। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত দান করেন। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
"আপনি তো হিদায়াত দিতে পারবেন না যাকে আপনি চান। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করেন।" [সুরা কাসাস : ৫৬]
আবু তালিব এক আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন। এটাও জানতেন যে মুহাম্মাদ সা. সত্যিই আল্লাহর রাসুল। কিন্তু তিনি কুরাইশের কাফিরদের নিন্দার ভয়ে ঈমানের সাক্ষ্য মুখে প্রকাশ করেননি। অথচ ঈমানের জন্য অন্তরে বিশ্বাস করার সাথে সাথে মুখেও বলা আবশ্যক।
রাসুলুল্লাহ সা. এর চাচাদের মধ্যে দুজন ঈমান এনেছিলেন। একজন হলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রা.। উহুদ যুদ্ধে নির্মমভাবে তিনি শহীদ হন। আরেকজন ঈমান এনেছিলেন অনেক পরে। তিনি আব্বাস রা.। তিনি রাসুলুল্লাহ সা. এর পর ইন্তেকাল করেন।
আব্বাস রা. রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আপনার চাচার জন্য কী করলেন? আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে রক্ষা করেছেন। তিনি আপনার জন্য কুরাইশের কাফিরদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সা. তখন বললেন, তিনি পায়ের টাখনুর সমান আগুনে থাকবেন। যদি আমি না থাকতাম তাহলে তিনি থাকতেন জাহান্নামের সবচেয়ে নিচের স্তরে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, আবু তালিব আমাদের জানামতে অমুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহ তার সাথে কী আচরণ করবেন তা আল্লাহই ভালো জানেন।
খাদিজা রা.এর ইন্তেকাল
রাসুলুল্লাহ সা. এর স্ত্রী খাদিজা রা. এই বছর ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানদের মা। যিনি তার সকল সম্পদ খরচ করেছিলেন রাসুলুল্লাহ সা. এর জন্য। খাদিজা রা. ছিলেন বলেই রাসুলুল্লাহ সা. নিশ্চিন্ত মনে দাওয়াতের কাজ করতে পেরেছিলেন।
যখন প্রথম অহি আসে তখন রাসুলুল্লাহ সা. খুব ভয় পেয়ে যান। সেসময় খাদিজা রা. তাকে অভয় দিয়েছিলেন এবং তাকে নিয়ে চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে যান। খাদিজা রা. সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেন।
রাসুলুল্লাহ সা. এর ছয়জন সন্তান খাদিজা রা. এর গর্ভে জন্ম নেন। তাঁর সাথে রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কেটেছে। এমনকি খাদিজা রা. বেঁচে থাকতে রাসুলুল্লাহ আর কোনো বিয়েও করেননি।
খাদিজা রা. এর সম্মান
খাদিজা রা. কে রাসুলুল্লাহ সা. অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তিনি বলেছিলেন, নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.। মহান আল্লাহ জিবরাইল আ. এর মাধ্যমে তাকে সুসংবাদ দিয়েছেন। জান্নাতে তাঁকে মুক্তার নির্মিত প্রাসাদ দেয়া হবে। সেখানে থাকবে না কোনো কোলাহল বা ক্লান্তি।
আয়েশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. প্রায়ই খাদিজা রা. এর কথা স্মরণ করতেন। তিনি বলতেন, যখন মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করেছে তখন খাদিজা আমার প্রতি ঈমান এনেছেন। যখন মানুষ আমাকে কষ্ট দিয়েছে তখন তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। খাদিজা রা. এর আগের স্বামীর সন্তানদেরকেও রাসুলুল্লাহ সা. ভালোবাসতেন। শুধু তাই নয়, খাদিজা রা. এর সাথে যাদের সুসম্পর্ক ছিল, তাদের সাথে রাসুলুল্লাহ সা. সম্পর্ক রক্ষা করেছেন।
রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনে এই বছরটি ছিল সবচেয়ে দুঃখের। এটি ছিল তাঁর নবুওত লাভের দশ বছর পরের ঘটনা। তখন তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর।
এত দুঃখেও রাসুলুল্লাহ সা. কিন্তু ভেঙে পড়েননি। তিনি নতুন উদ্যমে দাওয়াত দিতে থাকেন।
লেখক: নাজমুস সাকিব
প্রকাশের তারিখ : ৩০ জুন ২০২৪
শেয়ার করুন :
Currently Reading
