বনু হাশিমকে বয়কটের ঘটনা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পর ততদিনে পাঁচ-ছয় বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। দিনে দিনে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কুরাইশ কাফিরদের বিদ্বেষ এবং শত্রুতা। নিরাপত্তার জন্য সাহাবিদের মধ্য থেকে কয়েকজন হাবশায় হিজরত করেছেন। কাফিররা যখন দেখল, কোনোভাবেই আর মুসলমানদের দমানো যাচ্ছে না তখন তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল।
তখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব রাসুলকে আগলে রেখেছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কুরাইশের কাফিররা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এবার প্রাণে মেরে ফেলতে চায়। তিনি ভাতিজাকে রক্ষার জন্য বনু হাশিমকে আহবান করলেন।
বনু হাশিম হলো কুরাইশের একটি শাখা গোত্র। এমন অনেক শাখা গোত্র মিলে গঠিত আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশ। আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) ছিলেন বনু হাশিমের সন্তান।
আবু তালিবের আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন বনু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সবাই। শুধু কিছু মন্দ লোক এই আহবানে সারা দেয়নি। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল রাসুলেরই চাচা আবু লাহাব।
সেসময় আরবে একক কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না কোনো রাজা বা শাসক, কিংবা কোনো আদালত বা বিচারক। গোত্রীয় শাসনব্যবস্থাই ছিল সবকিছুর ভিত্তি। বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের যেমন কর্তব্য তার নাগরিককে রক্ষা করা, তেমনি সেসময় প্রতিটি গোত্র নিজেদের প্রতিজন সদস্যকে রক্ষা করত।
আবু তালিব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিরাপত্তা ঘোষণার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তারা কাবার একদম কাছে একটি উপত্যকায় নিয়ে আসেন। এই উপত্যকাটি ছিল বনু হাশিমের মূল বাসস্থান। আবু তালিব এর আহবায়ক ছিলেন বলে একে শিয়াবে আবু তালিব বলা হয়। শিয়াব মানে উপত্যকা বা গিরিপথ।
কুরাইশ যখন দেখল, বনু হাশিম মুহাম্মদ (সা.)-কে রক্ষার জন্য নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তখন তারা বনু হাশিম ও মুসলিমদেরকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিল। বয়কট শব্দটির সাথে আধুনিক যুগে আমরা সবাই পরিচিত। পণ্য বয়কটের মাধ্যমে আমরা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করে থাকি। আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে কুরাইশ কাফিররা মক্কায় মুসলিমদেরকে বয়কট করেছিল।
বনু হাশিমের প্রতি এই বয়কট ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক। কুরাইশের কাফিররা শপথ নিয়েছিল, তাদের কাছে কেউ কিছু বিক্রি করবে না। তাদের সাথে কেউ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না। তাদের সাথে কোনো চুক্তি, মেলা-মেশা এমনকি কথা পর্যন্ত বলবে না যতক্ষণ না তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তাদের হাতে সোপর্দ করে। আবু লাহাব ছাড়া বনু হাশিমের সবাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রক্ষায় এই অন্যায় বয়কটের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এবং তারা শিয়াবে আবু তালিবে অবরুদ্ধ জীবন-যাপন করতে শুরু করেন।
মক্কার মতো অনুর্বর মরুর শহরে এমন বয়কট মোটেও সহজ বিষয় ছিল না। এখানকার খাদ্যশস্য সব আসত বাইরে থেকে। তাই খাবার কিনে খেতে হত তাদের। কুরাইশরা যেহেতু কিছু তাদের কাছে বিক্রি করবে না এবং তাদের থেকে কিনবেও না বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তাই প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যায় বনু হাশিমের জন্য।
দিনে দিনে মজুত থাকা খাদ্য শেষ হয়ে আসে। মক্কার বাইরে থেকে আসা খাদ্যশস্যের কাফেলা পৌঁছতে দেয়া হত না গিরিপথে। এর আগেই কাফির সর্দাররা সব খাদ্য কিনে নিত। কখনো কখনো আবু লাহাব মক্কার বাইরে গিয়ে কাফেলার লোকদের বলত খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দিতে যেন বনু হাশিমের কেউ খাদ্য ক্রয় করতে না পারে। ক্ষুধায় ছটফট করত বনু হাশিমের শিশুরা। রাত হলে তাদের কান্না শোনা যেত। ক্ষুধায় কেউ কেউ গাছের পাতা চিবিয়ে খেত। সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর একটি বর্ণনা থেকে তাদের ক্ষুধার কষ্ট অনুধাবন করা যায়। তিনি একদিন আমি রাতের বেলা প্রস্রাব করছিলেন। যেখানে প্রস্রাব করছিলেন সেখানে কেমন খসখসে শব্দ হলো। তিনি খেয়াল করে দেখেন, সেখানে উটের চামড়ার একটি টুকরা পড়ে আছে। তিনি সেটি উঠিয়ে ধুয়ে তারপর পুড়িয়ে তিন দিন ধরে খেয়েছিলেন।
অথচ এই সাহাবি পরে একদিন হয়েছিলেন বীর মুসলিম সেনাপতি। পরাজিত করেছিলেন পারস্যের মতো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রকে। এছাড়া তিনি ছিলেন জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের একজন।
অন্যায় বয়কটনামা
কুরাইশের কাফিররা শুধু তাদের মৌখিক ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা এই বয়কটকে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করে। তারা একটি বয়কটনামা লিখে তা কাবায় ঝুলিয়ে রাখে। কে এই বয়কটনামা লিখেছিল তা নিয়ে সিরাত লেখকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে যে এটা লিখেছিল তার জন্য রাসুল (সা.) বদদোয়া করেন এবং তার হাত অবশ হয়ে যায়। মৃত্যু পর্যন্ত সে অবশ হাত নিয়েই বেঁচে ছিল।
দুঃসময়ের সাহায্যকারী
তবে বনু হাশিম ও মুসলিমদের এই দুর্দিনে মক্কার কিছু ব্যক্তি বনু হাশিম ও মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে হাকিম ইবনে হিযাম ও হিশাম ইবনে আমর।
হাকিম ইবনে হিযাম ছিলেন খাদিযা (রা.)-এর ভাইয়ের ছেলে। তিনি খাদিযা (রা.)-এর কাছে খাবার পাঠাতেন। একদিন আবু জাহল দেখে ফেলে যে হাকিম বনু হাশিমের কাছে খাবার পাঠাচ্ছেন। আবু জাহল চেঁচিয়ে ওঠে বলে, তুমি আর তোমার এই খাদ্য এখান থেকে যেন না নড়ে। আমি মক্কার সবাইকে জানিয়ে দিব যে তুমি বনু হাশিমকে খাবার দিয়েছ। কাছেই ছিলেন আরেকজন সাহায্যকারী আবুল বুখতারি। তিনি বলেন, তার ফুপুর কিছু খাদ্য তার কাছে ছিল। সেটা তাকে ফেরত দিতে সমস্যা কোথায়? এই বলে পড়ে থাকা উটের চোয়ালের হাড় নিয়ে আবুল বুখতারি আবু জাহলকে মেরে আহত করে ফেলেন। হাকিম ইবনে হিযাম পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হিশাম ইবনে আমর ছিলেন তার গোত্রের নেতা। তিনি বনু হাশিম বা কুরাইশ কোনো গোত্রেরই ছিলেন না। মানবিকতা ও আরব আভিজাত্য তার বিবেবককে নাড়া দিয়েছিল বনু হাশিমের দুর্দশা দেখে। তিনি উটের ওপর খাদ্যশস্য বোঝাই করে বনু হাশিমের এলাকার দিকে উটকে পাঠিয়ে দিতেন। উট হাঁটতে হাঁটতে সেখানে ঢুকে যেত।
বয়কট বাতিল
প্রায় তিন বছর পর্যন্ত এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সোপর্দ করার দাবিতে কুরাইশ কাফিররা বনু হাশিম ও মুসলিমদেরকে বয়কট করে রাখে।
যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া ছিলেন রাসুল (সা.)-এর ফুফাতো ভাই। সে হিসেবে বনু হাশিম ছিল তার মাতুল বংশ। একদিন হিশাম এসে তাকে বললেন, যুহাইর! আমরা খেয়ে থাকব, আর তোমার মামারা না খেয়ে থাকবে, এটা কেমনে তুমি সইতে পারো? যুহাইর তখন জানায়, আমি একা আর কী করতে পারি? আমার সাথে যদি আর কেউ থাকত! হিশাম বললেন, আমি আছি। এরপর তারা দুজনে মিলে মুতয়িম ইবনে আদি, আবুল বুখতারি ও যামআ ইবনুল আসওয়াদকে বয়কট বাতিলের জন্য রাজি করান। পরদিন সকালে তারা পাঁচজন মিলে কাবা তাওয়াফ করে মক্কাবাসীকে আহবান করে বলেন, হে মক্কাবাসী! আমরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকব আর বনু হাশিম ধ্বংস হয়ে যাবে, তা কী করে হয়? আল্লাহর কসম! এই অন্যায় বয়কটনামা না ছিঁড়ে আমি ক্ষান্ত হব না। সে সময় আবু জাহল তাকে বাধা দেয়। কিন্তু পাঁচজনের সাথে সে পেরে ওঠেনি।
এর মধ্যে আবু তালিব সেখানে উপস্থিত হন। কুরাইশরা খুব খুশি হয়েছিল এই ভেবে যে, হয়তো আবু তালিব এবার মুহাম্মদ (সা.)-কে তাদের হাতে ছেড়ে দিবেন। তিনি এসে তাদের সেই বয়কটনামা দেখতে চান।
কাবার ভেতর থেকে যখন বয়কটনামা বের করা হয় তখন কুরাইশ একদম বোকা বনে যায়। তারা দেখতে পায়, বয়কটনামায় লেখা বিসমিকা আল্লাহুম্মা অংশ ছাড়া পুরোটা পোকা খেয়ে ফেলেছে। এভাবে বয়কট বাতিল হয়ে যায় এবং বনু হাশিম স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিরাপত্তা
এই সময়ে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের। আবু তালিব ও বনু হাশিমের দৃঢ়তার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছিলেন।
বর্ণিত আছে, আবু তালিব রাতের বেলা রাসুল (সা.)-কে অন্য কারো বিছানায় শুইয়ে দিতেন এবং অন্য কাউকে এনে রাসুল (সা.)-এর বিছানায় রাখতেন। যদি রাতের বেলা কেউ তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় মারতে চায় তাহলেও যেন রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদ থাকেন।
উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
হিশাম পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার এই দয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো ভোলেননি। তাকে মক্কা বিজয়ের পর গণিমত হিসেবে প্রায় একশটি উট দান করেছিলেন।
আবুল বুখতারি বদর যুদ্ধে কাফিরদের সাথে এসেছিলেন। রাসুল (সা.) সাহাবিদের বলে দেন, তাকে যেন হত্যা না করা হয়।
এই সময়ে অন্যতম একজন সাহায্যকারী ছিলেন মুতয়িম ইবনে আদী। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সমর্থন করেছিলেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের দেখে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, আজ যদি মুতয়িম ইবনে আদি বেঁচে থাকতেন এবং এই আবর্জনাদের জন্য সুপারিশ করতেন, তাহলে আমি এদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম।
সুবহানাল্লাহ! আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে একটুও সংকোচবোধ করেননি। অথচ তারা অমুসলিম হয়েই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
লেখক: নাজমুস সাকিব
প্রকাশের তারিখ : ২ জুন ২০২৪
শেয়ার করুন :
Currently Reading
