বদর যুদ্ধ

গত পর্বে আমরা জেনেছি, রাসুলুল্লাহ সা. যুদ্ধ করার নিয়তে বদরে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন বাণিজ্য কাফেলা রোধ করার জন্য। কিন্তু বদরে যাবার পথে জানতে পারলেন, কাফিরদের এক বিশাল বাহিনী সেখানে আসছে যুদ্ধ করার জন্য।

 

একথা শুনে তারা কিন্তু পিছপা হননি। যুদ্ধের প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও খেজুরের ডাল হাতে কাফিরদেরকে মোকাবিলা করার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। সাহাবিরা সবাই ঐক্যমত ছিলেন যুদ্ধে যাবার বিষয়ে।

 

সর্বপরি মহান আল্লাহ এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ সাহায্য করেছেন তোমাদেরকে বদরে আর তোমরা ছিলে হীনবল। তাই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করতে পারো। যখন আপনি মুমিনদেরকে বলছিলেন, তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে তোমাদের রব তোমাদেরকে সাহায্য করবেন তিনহাজার অবতীর্ণ ফেরেশতাদের মাধ্যমে। অবশ্যই, যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো এবং তারা তোমাদের কাছে হঠাৎ এসে পড়ে তাহলে তোমাদের রব তোমাদেরকে পাঁচ হাজার সজ্জিত বাহিনী দিয়ে সাহায্য করবেন। আর আল্লাহ একে তোমাদের জন্য কেবল সুসংবাদ বানিয়েছেন এবং যেন তোমাদের এর মাধ্যমে তোমাদের অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। আর বিজয় কেবল মহাপরাক্রমশালী এবং মহাপ্রজ্ঞাবান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। [সুরা আলে ইমরান : ১২৪-১২৬]

 

এদিকে কুরাইশ বাহিনী এগিয়ে আসছিল বদরের দিকে। তারা জানতে পেরেছিল, তাদের কাফেলা বদর এলাকায় আছে। কিন্তু জুহফা নামের স্থানে আসার পর তারা খবর পায় যে তাদের ব্যবসায়িক কাফেলা নিরাপদে মক্কায় পৌঁছে গেছে। তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের যুদ্ধ এড়িয়ে মক্কায় ফিরে যাবার কথা। কিন্তু তারা খুব উৎসাহ নিয়ে এসেছিল। তাদের সাথে কুরাইশের নারী ও গায়িকা বাঁদীদেরকেও এনেছিল যারা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুসলিমদের নিন্দা করছিল।

 

যদিও কাফিরদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। একটি গোত্র তাদের সব সদস্যদের নিয়ে ফিরে যায়। মক্কার প্রবাঈন একজন যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে আহবান করেছিল। কিন্তু আবু জেহেলের কারণে সবাই যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল।

 

বদর প্রান্তরে যাবার পর রাসুলুল্লাহ সা. হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দেন কাফির নেতারা কে কোথায় মারা যাবে। আল্লাহর কী মহিমা! রাসুলুল্লাহ সা. যে স্থানে ইশারা করে দেখিয়েছিলেন ঠিক সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।

 

বদর যুদ্ধের আগের রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টিতে মুসলমানদের অনেক লাভ হয়েছিল। তাদের অবস্থান এলাকার বালুময় মাটি পানিতে ভিজে স্থিত হয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী বৃষ্টির কারণে ধূলার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করে। ওদিকে কাফিরদের হয় মহা বিপদ। বৃষ্টিতে তাদের অবস্থান এলাকার মাটি কাদায় একাকার হয়ে যায়। এতে কাফিরদের বাহিনী বেশ অসুবিধায় পড়ে।

 

সেই রাতে রাসুলুল্লাহ সা. সারারাত আল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে দুআ করেন। তিনি দুআ করছিলেন এই বলে, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন তা আমাকে দান করুন। হে আল্লাহ ! যদি আজ এই দলটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এই পৃথিবীতে এরপর আপনার ইবাদত করার মত আর কেউ থাকবে না।

 

রাসুলুল্লাহ সা. দুআ করতে করতে এত বেশি কাঁদছিলেন যে তাঁর কাঁধ থেকে তাঁর চাদর পড়ে গিয়েছিল। আবু বকর রা. চাদর তুলে গায়ে জড়িয়ে দেন এবং পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আল্লাহ আপনার জন্য যথেষ্ট। অবশ্যই তিনি তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়ন করবেন।

সেদিনের তারিখ ছিল ১৭ ই রমাদান। সকাল বেলা সাহাবিরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান। নামাযের কাতার সোজা করার মত করে রাসুলুল্লাহ সা. তাদের কাতার সোজা করে দেন।

 

এর মধ্যে কাফিরদের একজন মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে আসে। হামযা রা. তাকে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় মল্লযুদ্ধ। সেসময়ের আরবদের যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী তিনজন বীরকে ডাকা হয় মল্লযুদ্ধের জন্য।

 

কাফিরদের থেকে ওতবা, শায়বা ও ওলিদ এগিয়ে আসে। মুসলিম বাহিনী থেকে আসেন আওফ রা. মুয়াওয়েজ রা. এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তারা সবাই ছিলেন আনসারী। কুরাইশের কাফিররা তখন আপত্তি জানায়। তারা নিজেদের গোত্রীয় ভাই তথা মুহাজিরদের মধ্য থেকে কাউকে আসার জন্য আহবান জানায়। তখন হামযা রা., আলি রা. এবং উবায়দা রা. এগিয়ে আসেন। হামযা রা. ও আলি রা. তাদের দুই প্রতিদ্বন্দীকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। ওবায়দা রা. আহত হন। তার প্রতিদ্বন্দীকে হামযা রা. ও আলি রা. দুজন মিলে আবু ওবায়দার প্রতিদ্বন্দীকে হত্যা করেন।

 

এরপর দুই বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। মুসলিম বাহিনী বীর বিক্রমে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে মহান আল্লাহ তাঁর সম্মানিত তিন ফেরেশতা তথা জিবরাইল আ., মিকাইল আ. এবং ইসরাফিল আ. সহ কয়েক হাজার ফেরেশতা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

 

ফেরেশতারা যে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ছিলেন তার প্রমাণ সাহাবিদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। একজন আনসারি সাহাবি এক কাফিইরকে ধাওয়া করছিলেন। এর মধ্যে তিনি চাবুকের শব্দ শুনতে পান এবং দেখেন, তার সামনে সেই কাফির ধরাশায়ী হয়ে গেছে।

 

শুধু ফেরেশতারাই নন, সেই যুদ্ধে কাফিরদের পক্ষ হয়ে ইবলিশ অংশগ্রহণ করে কাফিরদেরকে কূটবুদ্ধি দেয়ার জন্য। সে মক্কার সুরাকা নামের একজনের বেশ ধারণ করে এসেছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে সে পালিয়ে যায়।

 

বদর যুদ্ধে মহান আল্লাহ তাঁর ওয়াদা অনুযায়ী মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুসলিম বাহ্নীর মাত্র ১৪ জন শহীদ হন। আর কাফিরদের মধ্য থেকে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এরা সবাই ছিল বড় বড় কাফির সরদার। আর বন্দী করা হয় ৭০ জনকে । অবশ্য তাদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দেয়া হয়।

 

কাফির সরদারদের লাশ বদরের একটি কুয়ায় ফেলে দেয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সা. তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তোমরা কি আজ আল্লাহর ওয়াদার প্রমাণ পেয়েছ? ওমর রা. জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এরা তো আপনার কথা শুনতে পাচ্ছে না। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তারা তোমার চেয়ে ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু জবাব দিতে পারছে না।

 

লেখক: নাজমুস সাকিব


প্রকাশের তারিখ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪

শেয়ার করুন :

Currently Reading

বদর যুদ্ধ

Contact Us

,

Design & Developed by Neoscoder © 2025 - All right reserved by Ampublications

  • Privacy Policy
  • Terms & Conditions
  • Help & Support