আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন

রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় আগমনের পর সেখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা করব এই পর্বে। আমাদের সিরাতের মূল উদ্দেশ্য যদিও রাসুলুল্লাহ সা. এর পবিত্র জীবনী পড়া এবং বুঝা। তবে তা ভালোভাবে বুঝার জন্য পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয়ও আলোচনা করা দরকার। তাহলে রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তার প্রেক্ষাপট আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারব ইনশা আল্লাহ।

 

মদিনার অধিবাসীদের বিভিন্ন শ্রেণি

সেসময় মদিনায় যারা ছিল তাদের কথা আমরা বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি। প্রথমত সেখানকার মূল অধিবাসীরা ছিলেন আরব। তাদের মধ্যে মূল গোত্র ছিল দুটি, আওস ও খাযরাজ। এদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন আনসার।

 

সেখানে মক্কা থেকে আসা সাহাবিরা পরিচিত ছিলেন মুহাজির হিসেবে। এছাড়া ছিল ইহুদিরা। তারা শামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল। তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে জানতে পেরেছিল যে শেষনবি এই মদিনায় আসবেন। তাদের ধারণা ছিল, শেষ নবি ইসহাক আলাইহিস সালামের বংশে আসবেন। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাদের রাসুল সা. কে পাঠিয়েছেন ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে একটা ক্ষোভ সবসময় কাজ করত।

 

মুসলিম, ইহুদি ও মুশরিক, এই তিন শ্রেণির বাইরে আরেকটি শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল মদিনায়। তারা হলো মুনাফিক। মক্কায় মুসলিমদের শত্রু ছিল শুধুমাত্র আরব মুশরিকরা। মদিনায় ইহুদি ও মুনাফিক, এই দুই শ্রেনি নতুন করে আরও যুক্ত হলো।

 

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব

আমরা আগেই জেনেছি, আরবের শাসন ব্যবস্থা ছিল গোত্রীয় শাসনব্যবস্থা। ছোট ছোট শাখা গোত্র মিলে বড় গোত্রের অধীনে থাকত। বড় গোত্রগুলো আবার অন্য গোত্রদের মিত্র হয়ে থাকত। গোত্রের ভয়ে কেউ কাউকে কিছু বলতে সাহস পেত না। কেউ যদি কারো প্রতি অন্যায় করত তখন পুরো গোত্র তার পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণ করত। গোত্রীয় এই ব্যবস্থা ছিল খুবই সুদৃঢ়। এমনকি আমাদের রাসুলুল্লাহ সা. ও মক্কায় গোত্রীয় ব্যবস্থার কারণে নিরাপদে ছিলেন। বনু হাশিমের অনেকে ইসলাম গ্রহণ না করলেও রাসুলুল্লাহ সা.এর নিরাপত্তার বিষয়ে তারা ছিলেন আপোষহীন। এজন্য কাফিররা তাঁকে প্রাণে মারতে সাহস করেনি প্রথমদিকে। পরে অবশ্য সব গোত্র থেকে একজন বাছাই করে তারা রাসুলুল্লাহ সা. এর ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল যেন এর দায় সব গোত্রের ওপর আসে। সেই রাতে মহান আল্লাহর আদেশে রাসুলুল্লাহ সা. গারে সাওরে চলে যান।

 

মক্কা থেকে মদিনায় যেসকল সাহাবি হিজরত করেছিলেন তারা সবাই নিজের পরিবার ও গোত্রকে ছেড়ে এসেছিলেন। তাই মদিনায় তাদের আত্মীয় বা কাছের কেউ ছিল না। কিন্তু সমাজে চলতে হলে নানাকারণে আত্মীয় ও স্বজনদের দরকার হয়।

 

মদিনার জীবনে মুহাজির সাহাবিরা যেন একদম নিঃসঙ্গ না হয়ে যান সেজন্য রাসুলুল্লাহ সা. এক অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তিনি আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। একজন আনসার ও একজন মুহাজিরকে নিয়ে দুজনকে ভাই বানিয়ে দেন। এভাবে মক্কা থেকে আসা মুহাজিররা মদিনায় আশ্রয় খুঁজে পান। মদিনার আনসাররা ছিলেন খুবই উদার। তারা এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানান। তারা নিজের মুহাজির ভাইকে নিজেদের সবকিছুতে অংশীদার করে নেন।

 

মদিনায় খেজুর উৎপন্ন হতো খুব। আনসাররা ছিলেন বাগানের মালিক। মুহাজিররা আনসারদেরকে সহযোগিতা করেন বাগানের কাজে। তারা চেয়েছিলেন তাদেরকে বাগান ভাগ করে দিয়ে দিতে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. অসম্মতি জানান। তখন আনসাররা তাদেরকে তাদের কাজের বিনিময়ে ফল ভাগ করে দেন।

 

মুহাজিরদের জন্য আনসারদের ত্যাগ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। সাদ ইবনে রবি নামে একজন সাহাবির ভাই হয়েছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.। সাদ ইবনুর রবি তাকে বলেছিলেন, আমার দুই স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনার পছন্দ হয় তাকে আমি তালাক দিব। ইদ্দত শেষ হলে আপনি তাকে বিয়ে করতে পারবেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. তাকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে শুধু বাজারের রাস্তা দেখিয়ে দিন। তিনি নিজ যগ্যতায় ব্যবসা করে একসময় মদিনার অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

 

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যে ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা ছিল মহান আল্লাহরই দান। আল্লাহ বলেছেন, তিনি তাদের হৃদয়ের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। যদি আপনি পৃথবীতে যা আছে তা খরচ করতেন তবু তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতেন না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। [সুরা আনফাল : ৬৩]

 

তবে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যে ভাই-ভাই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা ছিল শুধুই সামাজিক। প্রকৃতভাবে তারা একে অন্যের ভাই ছিলেন না। মহান আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে আত্মীয়তার সম্পর্কই আসল।

 

লেখক: নাজমুস সাকিব


প্রকাশের তারিখ : ২৭ অক্টোবর ২০২৪

শেয়ার করুন :

Currently Reading

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন

Contact Us

,

Design & Developed by Neoscoder © 2025 - All right reserved by Ampublications

  • Privacy Policy
  • Terms & Conditions
  • Help & Support